✦ ভূমিকা :
The Schachter-Singer theory, also known as the two-factor theory of emotion, posits that emotions arise from the interaction of physiological arousal and cognitive labeling of that arousal.
মানবজীবনে ‘অনুভূতি’ বা Emotion এমন একটি জটিল মানসিক অবস্থা যা একই সঙ্গে শারীরবৃত্তীয় (physiological), জ্ঞানমূলক (cognitive) ও আচরণগত (behavioral) প্রতিক্রিয়ার সমন্বয় ঘটায়। মানব আবেগ কেবলমাত্র অন্তরস্থ এক অনুভূতির বিষয় নয়; বরং এটি ব্যক্তির চিন্তা, ব্যাখ্যা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
এই প্রেক্ষাপটে Stanley Schachter ও Jerome E. Singer (1962) এক নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করেন যা আবেগের ক্ষেত্রে জ্ঞান (cognition) ও শারীরবৃত্তীয় উত্তেজনার (arousal) সমন্বিত ভূমিকা ব্যাখ্যা করে। এ তত্ত্বটি মনোবিজ্ঞানে পরিচিত “দুই উপাদান তত্ত্ব” (Two-Factor Theory of Emotion) নামে।
✦ তত্ত্বের মূল ভাবনা :
শ্যাখটার ও সিঙ্গার তাঁদের গবেষণায় বলেন যে—
“Emotion = Physiological Arousal + Cognitive Label”
অর্থাৎ, কোনো আবেগ অনুভূত হওয়ার জন্য দুটি মূল উপাদান একত্রে কাজ করে—
শারীরবৃত্তীয় উত্তেজনা (Physiological Arousal)
উত্তেজনার মানসিক ব্যাখ্যা বা চিহ্ন (Cognitive Interpretation or Label)
তাঁরা বলেন, কেবলমাত্র শরীরের প্রতিক্রিয়া থেকেই আবেগ নির্ধারিত হয় না (যেমন জেমস–ল্যাং তত্ত্ব বলেছিল), বরং সেই প্রতিক্রিয়াকে ব্যক্তি কীভাবে ব্যাখ্যা বা চিহ্নিত করেন, তা-ই আবেগের প্রকৃতি নির্ধারণ করে।
✦ তত্ত্বের বিশদ ব্যাখ্যা
শ্যাখটার ও সিঙ্গারের মতে, আবেগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া তিনটি ধাপে ঘটে থাকে—
(১) শারীরবৃত্তীয় উত্তেজনা (Physiological Arousal)
কোনো পরিস্থিতি বা উদ্দীপকের (stimulus) প্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেহে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু পরিবর্তন ঘটে—
যেমন: হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, ঘাম, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, রক্তচাপ বৃদ্ধি ইত্যাদি।
➡ উদাহরণ : কেউ যদি হঠাৎ অন্ধকারে একটা অজানা আওয়াজ শোনে, তখন তার শরীরে এক ধরণের উত্তেজনা বা arousal তৈরি হবে।
(২) জ্ঞানমূলক ব্যাখ্যা বা লেবেলিং (Cognitive Labeling)
এই উত্তেজনার অর্থ আমরা আমাদের মানসিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে নির্ধারণ করি। আমরা ভাবি—“এই উত্তেজনা ভয়জনিত নাকি আনন্দজনিত?”
এই ব্যাখ্যা পরিস্থিতিভেদে পরিবর্তিত হয়।
➡ যেমন, যদি আমরা দেখি কেউ ছুরি হাতে আসছে, তাহলে আমরা এই শারীরবৃত্তীয় উত্তেজনাকে ‘ভয়’ হিসেবে চিহ্নিত করব; কিন্তু প্রিয়জনকে হঠাৎ দেখে উত্তেজিত হলে, সেটিকে ‘আনন্দ’ হিসেবে চিহ্নিত করব।
(৩) আবেগের অভিজ্ঞতা (Experience of Emotion)
শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া এবং তার মানসিক ব্যাখ্যার সমন্বয়েই চূড়ান্তভাবে একটি আবেগ জন্ম নেয়।
এই দুই উপাদানের সংযোগেই মানুষ বলে—“আমি ভয় পাচ্ছি” বা “আমি আনন্দিত”।
✦ তত্ত্বের গবেষণামূলক প্রমাণ (Experimental Evidence)
শ্যাখটার ও সিঙ্গার (1962) একটি বিখ্যাত ইপিনেফ্রিন (Epinephrine) পরীক্ষা পরিচালনা করেন।
এই পরীক্ষায় তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তিনটি দলে ভাগ করেছিলেন। প্রতিটি অংশগ্রহণকারীকে বলা হয়েছিল তারা একটি “নতুন ভিটামিন ইনজেকশন” পাচ্ছে, কিন্তু আসলে তাদের Epinephrine (adrenaline) ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল, যা শারীরবৃত্তীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে (যেমন হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, ঘাম, ইত্যাদি)।
পরীক্ষার ধাপ:
দল–১: অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়েছিল এই ইনজেকশন তাদের হৃদস্পন্দন বাড়াবে (অর্থাৎ তারা উত্তেজনার কারণ জানত)।
দল–২: তাদের কিছুই বলা হয়নি (অর্থাৎ তারা উত্তেজনার কারণ জানত না)।
দল–৩: তাদের মিথ্যা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
এরপর প্রতিটি দলের অংশগ্রহণকারীদের একজন সহযোগী (confederate) এর সঙ্গে রাখা হয়। সেই সহযোগী কখনও আনন্দিত আচরণ করত, কখনও রাগান্বিত আচরণ করত।
ফলাফল:
→ যাঁরা উত্তেজনার কারণ জানতেন না, তাঁরা সহযোগীর আচরণের সঙ্গে নিজেদের আবেগ মেলাতে শুরু করেন।
যদি সহযোগী আনন্দিত থাকেন, অংশগ্রহণকারীরাও আনন্দিত অনুভব করতেন; যদি সহযোগী রাগান্বিত থাকেন, তাঁরাও রাগান্বিত হতেন।
অন্যদিকে, যারা জানতেন যে তাদের উত্তেজনা ইনজেকশনের ফল, তারা বাহ্যিক পরিস্থিতিকে আবেগের কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেননি।
➡ উপসংহার :
শুধুমাত্র শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া নয়, সেই প্রতিক্রিয়ার মানসিক ব্যাখ্যা বা “labeling”–ই চূড়ান্ত আবেগ নির্ধারণ করে।
✦ তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য :
দ্বি-উপাদান কাঠামো (Two-Factor Structure): আবেগ জন্ম নেয় শারীরবৃত্তীয় উত্তেজনা ও জ্ঞানমূলক ব্যাখ্যার যুগপৎ প্রক্রিয়ায়।
পরিস্থিতি নির্ভরতা (Situational Dependence): আবেগের ব্যাখ্যা বা label নির্ভর করে পরিবেশ ও প্রসঙ্গের উপর।
ব্যক্তিগত পার্থক্য: একই ধরনের উত্তেজনা ভিন্ন ব্যক্তির কাছে ভিন্ন আবেগ হিসেবে প্রকাশিত হতে পারে, কারণ তাদের মানসিক ব্যাখ্যা ভিন্ন।
জ্ঞানমূলক দৃষ্টিভঙ্গি: এই তত্ত্ব প্রথম দিকের এমন এক ব্যাখ্যা যা আবেগকে সম্পূর্ণভাবে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, জ্ঞান ও চিন্তার ভূমিকা গুরুত্ব দিয়েছে।
✦ উদাহরণ :
একজন ছাত্র পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় উত্তেজিত। যখন সে ভালো ফল পায়, সে বলে “আমি আনন্দিত।”
কিন্তু যদি খারাপ ফল পায়, সে একই শারীরবৃত্তীয় উত্তেজনাকে “ভয়” বা “হতাশা” হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
অর্থাৎ, শরীরের প্রতিক্রিয়া একই হলেও মানসিক ব্যাখ্যা বদলে গেলেই আবেগ বদলে যায়।
✦ সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ (Critical Evaluation)
✅ তত্ত্বের গুণাবলি :
জ্ঞানমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তন :
শ্যাখটার–সিঙ্গার তত্ত্ব প্রথম আবেগতত্ত্ব যা বলে, “কী অনুভব করছি তা নির্ভর করে আমরা কীভাবে সেটিকে ব্যাখ্যা করছি।”
→ এটি আবেগ–মনোবিজ্ঞানে Cognitive Revolution–এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
প্রায়োগিক সমর্থন :
তাঁদের ইপিনেফ্রিন পরীক্ষাটি পরবর্তী বহু গবেষণার ভিত্তি তৈরি করে, যেখানে দেখা যায় আবেগীয় প্রতিক্রিয়া প্রায়ই ব্যাখ্যা নির্ভর।
উদাহরণ: Dutton & Aron (1974) এর “Bridge Experiment” – যেখানে দেখা যায় উচ্চ সেতু পার হওয়ার সময় শারীরবৃত্তীয় উত্তেজনাকে মানুষ প্রেমজনিত উত্তেজনা হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করে।
বাস্তব জীবনের প্রয়োগযোগ্যতা :
তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে কেন কখনও আমরা একই ঘটনার জন্য ভিন্ন আবেগ অনুভব করি, বা কেন পরিবেশের পরিবর্তনে আবেগ বদলে যায়।
❌ তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা :
শারীরবৃত্তীয় পার্থক্যের অস্বীকার :
সমালোচকদের মতে, সব আবেগে শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া এক নয়। যেমন “ভয়” ও “রাগ”-এর শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া আলাদা। কিন্তু শ্যাখটার–সিঙ্গার তত্ত্ব এটিকে সাধারণীকরণ করেছে।জ্ঞানমূলক ব্যাখ্যার গুরুত্ব অতিরঞ্জিত :
কেউ কেউ বলেছেন, অনেক সময় আবেগ এত দ্রুত ঘটে (যেমন হঠাৎ ভয় পাওয়া) যে সেখানে চিন্তা বা ব্যাখ্যার ভূমিকা খুব সীমিত।
→ Zajonc (1980) বলেন, “We feel before we think.”
অর্থাৎ, কখনও আবেগ চিন্তার আগেই ঘটে।পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা :
তাঁদের ইপিনেফ্রিন পরীক্ষায় পরিবেশ সম্পূর্ণ কৃত্রিম ছিল, তাই বাস্তব জীবনে এর পুনরাবৃত্তি করা কঠিন। অনেক গবেষক একই ফলাফল পুনরায় পেতে ব্যর্থ হন।সাংস্কৃতিক পার্থক্যের প্রতি অবহেলা :
তত্ত্বটি ধরে নিয়েছিল যে আবেগের ব্যাখ্যা সর্বত্র সমান, কিন্তু বাস্তবে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আবেগের ব্যাখ্যা ভিন্ন হয়।
✦ অন্যান্য তত্ত্বের সঙ্গে তুলনা :
| তত্ত্ব | মূল ধারণা | শ্যাখটার–সিঙ্গার তত্ত্বের পার্থক্য |
|---|---|---|
| James–Lange Theory | আবেগের কারণ কেবল শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন | শ্যাখটার–সিঙ্গার যোগ করেছেন জ্ঞানমূলক ব্যাখ্যার ভূমিকা |
| Cannon–Bard Theory | শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক প্রতিক্রিয়া একসঙ্গে ঘটে | শ্যাখটার–সিঙ্গার বলেন, প্রথমে উত্তেজনা, তারপর ব্যাখ্যা |
| Lazarus’ Cognitive Appraisal Theory | আবেগের পূর্বে জ্ঞানমূলক বিশ্লেষণ ঘটে | শ্যাখটার–সিঙ্গার বলেন, উত্তেজনা আগে, ব্যাখ্যা পরে |
✦ উপসংহার :
শ্যাখটার–সিঙ্গার তত্ত্ব আবেগ–মনোবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক মাইলফলক (milestone) হিসেবে গণ্য হয়।
এটি প্রথম স্পষ্টভাবে দেখিয়েছিল যে আবেগ কেবল দেহের প্রতিক্রিয়া নয়, বরং তার অর্থের ব্যাখ্যা।
এই তত্ত্বের মাধ্যমেই আবেগীয় অভিজ্ঞতার মধ্যে জ্ঞান, চিন্তা ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকা স্বীকৃতি পেয়েছে।
“Emotion is not just what happens to our body, but what we think it means.” — Schachter & Singer (1962)
যদিও এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবু এটি আধুনিক আবেগতত্ত্বের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করেছে, যার ওপর পরবর্তী তত্ত্বগুলি যেমন Lazarus, Zajonc, LeDoux প্রমুখ তাঁদের গবেষণা নির্মাণ করেছেন।
✦ সংক্ষেপে মূল বক্তব্য :
আবেগের জন্য দুটি উপাদান প্রয়োজন — শারীরবৃত্তীয় উত্তেজনা ও জ্ঞানমূলক ব্যাখ্যা।
উত্তেজনা একই থাকলেও পরিস্থিতি ও ব্যাখ্যা বদলালে আবেগ বদলে যায়।
আবেগ একটি সক্রিয় জ্ঞানমূলক প্রক্রিয়া।
তত্ত্বটি আবেগ–মনোবিজ্ঞানে “Cognitive Approach”–এর ভিত্তি স্থাপন করেছে।
